বাবার না বলা কথা - Bengali Story |Sad Story
Bangala Golpo পড়তে কারনা ভালো লাগে তাই আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি নতুন একটি Sad Story -"বাবার না বলা কথা" | Love Story Sad এর এই গল্পটি অবশ্যই আপনাদের পছন্দ হবে ।
চলুন তাহলে শুরু করা যাক আজকের গল্প :-
বাবার না বলা কথা
দুরু দুরু বুকে ট্রেন থেকে নেমে দেবীপুর স্টেশনের মাটিতে পা রাখল গৌরব। একবার সে তাকিয়ে দেখল চারিদিকে, সবকিছু তো একই রকম আছে……সেই স্টেশনের বসার জায়গাগুলো, রেল লাইনগুলো, ওভারব্রিজ, স্টেশন চত্বরের সেই সব দোকানপাট…..এমনকি অন্য দিনের মত, ২ নাম্বার প্ল্যাটফর্ম-এর একধারে সেই অন্ধ ভিকারীটাও একই ভাবে বসে আছে আজকে। সেই মানুষজন, হৈ-হল্লা, হুটোপাটি….সব…..সব সেদিনের মত একই রকম আছে আজকেও, যেদিন সে বাড়ি থেকে কলকাতার উদ্দেশ্য রওনা হওয়ার জন্য মনে খুশির উদ্দাম নিয়ে এই স্টেশনেই এসেছিল এক সপ্তাহ আগে। কিন্তু বাকি সবকিছু এক থাকলেও, তার জীবনে কি ভয়ানক পরিবর্তন এসেছে আজ, ভাবল গৌরব……কি দুর্বিষহ বিপর্যয় ঘটে গেছে আজকেই!
কাঁপা কাঁপা পা ফেলে সাব-ওয়ের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে, সে ভাবল যে বোধহয় এবার পড়েই যাবে মাথা ঘুরে। কিন্তু তাহলে তো চলবে না, ওকে যে এখনো অনেক দূরে যেতে হবে। স্টেশনের সামনের রাস্তাটা কোনোভাবে পার করে সে ছুটে গেল বাস-স্ট্যান্ডের দিকে। সৌভাগ্যবশত, একটা বাস তখনই স্টার্ট নিল গোবিন্দপুরের উদ্দেশ্যে। কন্ডাক্টরের সহায়তায়, সে কোনোরকমে বাসের ভেতর উঠে, পেয়ে গেল একটা বসার জায়গা। একবার ক্লান্তির ঘোরে চোখ বুজল সে……আজকের সকাল থেকে ওর জীবনে ঘটা সমস্ত ঘটনা যেন একে একে ভেসে উঠতে লাগল ওর চোখের সামনে।
গোবিন্দপুরের নাম করা সাহা-বাড়ির ছেলে সে। ওখানে ওদের প্রায় সাত পুরুষের বাস। রাজা বা জমিদার না হলেও, ওদের পরিবার সেই তল্লাটের সবচেয়ে বড় বনেদি ব্যবসাদারদের মধ্যে একটি। তবে, সেই ইংরেজ আমল থেকে চলে আসা ওদের বংশানুক্রমিক পাটের ব্যবসার এখন আর কিছুই বেঁচে নেই। পরিবারের শরিকরাও যে যার নিজের ভাগের জমি-জমা বিক্রি করে, পাড়ি দিয়েছে কলকাতা তথা গোটা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায়, আর কোনোদিন ফিরে না আসার তাগিদে। তবে সেই হৃত বংশ-মর্যাদা আর আভিজাত্য যেন এখনো ছাড়তে পারেননি গৌরবের বাবা, রণধীর বাবু। সবাই এই গোবিন্দপুর ত্যাগ করলেও তিনি যেন এখনো ছাড়তে পারেননি তার পূর্বপুরুষের বিশাল বড় ভিটেটাকে। এখনো সেই প্রাচীন ইঁটগুলোকে আঁকড়ে ধরে, এ বাড়িতেই থেকে, তিনি প্রতিনিয়ত লড়ে যান একাকীত্বের সাথে। তিনি এই গ্রামেরই উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলটির হেড-মাস্টার ছিলেন, এখন অবসর নিয়েছেন কয়েক বছর আগে।
গৌরবের যখন সবে চার বছর বয়স, তখনই তার মা নিরূপাদেবী কোনো এক দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন। তারপর আর কোনো বিবাহ করেননি রণধীরবাবু। তাই শুধুমাত্র ফটো ফ্রেম ছাড়া, মাকে খুব একটা বেশি কোথাও দেখেছে বলে তো মনে করতে পারে না গৌরব। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল গৌরব। বেশ ভালো নাম্বার পেয়ে গ্রামের সেই স্কুলটি থেকেই উচ্চ-মাধ্যমিক পাস করে সে। এরপর জয়েন্টে বেশ ভালো ফল করে, সুযোগ পায় কলকাতার একটি নামি সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার। তারপর সল্ট-লেকের একটি বহু-জাতিক তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানীতে মোটা বেতনের চাকরিও জুটিয়ে ফেলে সে, কিছু দিনের মধ্যে। তারপর বিধাননগরে নিজেই ফ্ল্যাট কিনে, গোবিন্দপুর ছেড়ে হয়ে ওঠে কলকাতার বাসিন্দা। তবে বাবার প্রতি কোনো কর্তব্যেরই কোনো ত্রুটি রাখেনি সে কোনোদিন। তাকে বার বার বলেছে, কলকাতায় এসে তার ফ্ল্যাটেই থাকার জন্য। কিন্তু সে কথা শুনেও কখনো কানে তোলেননি রণধীরবাবু। কিন্তু তাতেও বাবার প্রতি টানের কোনো কমতি হয়নি গৌরবের, সে প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিনগুলিতে গোবিন্দপুরের বাড়িতে আসে, বাবার খবরাখবর নিতে। এই যেমন এই আগের সপ্তাহের শনি-রবিবারও সে এই গোবিন্দপুরেই কাটিয়েছে।
এমন সময়ই বেজে উঠল তার ফোন। গৌরব ফোনটা পকেট থেকে বার করে দেখল যে প্রিয়ার নাম্বার সহ ছবিটা ভেসে উঠছে স্ক্রীনে। প্রিয়া গৌরবের অফিসেই কাজ করে, বছরখানেকের সম্পর্ক ওদের। এই বছরের ডিসেম্বর মাসেই ওদের বিয়ে পাকা হয়ে গিয়েছে। ফোনটা ধরতেই প্রিয়া উৎকণ্ঠা মেশানো কণ্ঠে বলল,
- কিগো, পৌঁছলে বাড়ি? ইস এভরি থিং অল রাইট?
- না গো, এখনো বাসে আছি…..পৌঁছিয়েই তোমায় জানাবো সব কথা….তুমি শুধু একবার ওই ক্লায়েন্ট-টাকে……..
- ও সব নিয়ে তুমি ভেবো না…..আমি আছি তো অফিসে……
- থ্যাংকস প্রিয়া……
- আচ্ছা, আর বেশি ডিসটার্ব করবো না তোমায়…..পৌঁছে ফোন করো…..বাই…..টেক কেয়ার…..
ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে আবার ভাবতে লাগল গৌরব।
আজ কিন্তু শনি বা রবিবার নয়। আজ সকালে যথারীতি গৌরব তার সল্ট-লেকের ইকো-স্পেস বিজনেস পার্কের অফিসে, নিজের জায়গায় বসে ব্যস্ত ছিল এক ক্লায়েন্ট-কে নিয়ে। হটাৎ বেজে উঠল ফোন। ও দেখল ওদের গোবিন্দপুরের বাড়ির বহুদিনের চাকর হরিদা ফোন করেছে ওকে। কেমন যেন একটা অস্বস্তি লাগল ওর এটা দেখে, হরিদার আবার কি দরকার হল ওকে? ও ফোনটা তাড়াতাড়ি রিসিভ করেই শুনল যে ওপার থেকে হরিদা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। গৌরব উৎকণ্ঠার সাথে বলে উঠল,
- কি….কি হয়েছে হরিদা?
হরিদা যেন কিছু বলতে আর পারে না, সে কেঁদেই চলল,
- দাদাবাবু……দাদাবাবু…….দাদাবাবু গো……
- ওফ……তুমি কিছু বলবে……নাকি শুধু কেঁদেই যাবে…..
- দাদাবাবু…..দাদাবাবু……বাবুর…..বাবুর……
গৌরব চিৎকার করে উঠল,
- কি হয়েছে বাবার……বল হরিদা বল……কি হয়েছে বাবার?
হরিদা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
- আজ সকালেই হার্ট এটাক করেছে বাবুর……পাড়ার সবাই মিলে আজ তাকে, ওই যে চৌমাথার মোড়ে যে নার্সিং-হোমটা আছে……… ওখানেই ভর্তি করেছে তাকে…….অবস্থা খুব একটা ভালো নয় গো দাদাবাবু……তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো……..
ব্যাস তারপরে অফিসের সেই দশতলার ইমারতটা থেকে, রুদ্ধশ্বাসে, সে যে কি করে এই বাসে চলে এলো……তা যেন তার আর মনেই পড়ল না গৌরবের। হটাৎ কন্ডাক্টরের চিৎকারে চিন্তার ঘোর কাটল গৌরবের,
- গোবিন্দপুর…..গোবিন্দপুর এসে গেছে……কে নামবে নেমে যান……
বাস স্ট্যান্ড থেকে রিকশা করে সেই নার্সিং-হোমে যেতে যেতে বাবার কত কথা মনে পড়ছিল গৌরবের। সেই যে ছোটবেলায় পাটিগণিতের অঙ্কগুলো করতে গিয়ে যোগে বিয়োগে ভুল করে তার কাছ থেকে কান-মলা খাওয়া………সেই বিকাল বেলায় গ্রামের মাঠে গিয়ে বাবার সাথে প্রথম সাইকেল চালানো শেখা…….প্রতি রবিবার মাংস-ভাত নিজেই রাঁধতেন তার বাবা……সেই বাবার ভয়ে বাড়ির এদিক সেদিকে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রথম সিগারেট খাওয়া……সেই ছোটবেলায় মাঝে মাঝে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে দেখা যে তাদের উচ্চতার আর কতটা তফাৎ আছে……আর ভাবতে পারলনা গৌরব। দুচোখে জল এসে গেল তার। নার্সিং-হোমের সামনে আসতেই কোনো মতে রিকশার ভাড়া মিটিয়ে ছুটে গেল সে তার ভেতরে।
তবে বেশি দূর আর যেতে হল না তাকে। নার্সিং-হোমের লম্বা বারান্দার এক ধারেই দেখা হয়ে গেল হরিদার সাথে। তাকে দেখে, হরিদা হাউ মাউ করে কেঁদে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকে। শঙ্কিত গলায় সে হরিদাকে জিজ্ঞাসা করল,
- বাবা……বাবা….বাবা কেমন আছে হরিদা?
কোনো উত্তর দিল না হরিদা, শুধু হাপুস নয়নে কেঁদেই চলল সে। এবার যথেষ্ট জোরে চিৎকার করে উঠল গৌরব,
- আমার কথার উত্তর দাও, হরিদা…….বাবা কেমন আছে?
সে কান্নায় ভেঙে পড়া কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল,
- তোমার বড় দেরি হয়ে গেল দাদাবাবু……..বড় দেরি হয়ে গেল……..এই আধঘন্টা আগেই বাবু আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন গো দাদাবাবু….ছেড়ে চলে গেলেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে……
কিছুক্ষন দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে রইল গৌরব, মুখ দিয়ে কোনো কথা বার হল না তার। হরিদা এবার তার দুচোখ মুছে ছুটে এল গৌরবের আরো কাছে, তারপর উত্তেজিত হয়ে সে বলল,
- দাদাবাবু…..দাদাবাবু গো……জান তো……বাবু তার শেষ সময়ে আপনার নাম ধরে বার বার ডাকছিলেন……আমি স্পষ্ট শুনেছি গো দাদাবাবু……আমি নিশ্চিত…..আমি নিশ্চিত…..তিনি আমাদের সকলকে ছেড়ে যাওয়ার আগে…..তোমাকে……তোমাকে যেন কিছু বলে যেতে চাইছিলেন…..এমন কিছু যা হয়ত তিনি আজ অবধি কাউকে বলেননি…….
এই কথা শুনে যেন হুঁশ ফিরে পেল গৌরব। বাবাকে হারানোর শোকের শীতলতার মধ্যে, তার শরীরে যেন গর্জে উঠল আতঙ্ক আর কৌতূহলের ঝড়। ভাবল সে, কি এমন কথা আছে, যা সারা জীবনে না বললেও, নিজের আসন্ন মৃত্যুর কথা বুঝেই হয়তো বাবা তাকে বলতে চেয়েছিলেন!
চলবে......
আরো নতুন নতুন Bangla Golpo এবং Poem পড়ার জন্য এক্ষুনি আমাদের সাইটটিকে বুকমার্ক করে রাখুন এবং আমাদের ফেসবুক পেজ টি লাইক করুন যাতে পরবর্তী নতুন কোন Bengali Golpo বা Kobita আমাদের সাইটে প্রকাশ হলে আমাদের সাইটের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলির দ্বারা আপনি আপডেট পেয়ে যান ।

0 Comments